
সাইফুর নিশাদ
ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়েছে বেশ অনেকদিন আগে। কিন্তু এবার ঘটা করে বর্ষারানি হাজির হলো। আষাঢ়ের প্রথম দিন আজ। গত বছরের মতো আষাঢ় আবার তার নূপুরের শব্দ শোনাল। হয়তো এই দুঃসময়ে কদম, কেতকী ধোয়া বৃষ্টি বাঙালির হৃদয়ে সাহস জোগাবে আরও একবার।
বর্ষা মানেই আবেগবর্ষা আমাদের জন্য অপরিহার্য এক ঋতু। বৃষ্টি না হলে শস্যাদি জন্মাবে না, বেড়ে উঠবে না প্রাণ। বৃষ্টির অভাবে মাটি যখন অনুর্বর হয়ে যায়, তখন বর্ষা এসে তা উর্বর করে। আমাদের নদী, মাঠ, ঘাটের দেশ বর্ষায় ভরে ওঠে সবুজে শ্যামলে।
বর্ষা মানেই অনুভূতির জোয়ার। এ জোয়ারে ভাসেননি এমন কবি, সাহিত্যিক পাওয়া যায় না। শুধু যে কবি-সাহিত্যিক, তা নয়-সাধারণ মানুষও। কালীদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ বা নির্মলেন্দু গুণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে হুমায়ূন আহমেদ-কেউ বর্ষাকে এড়িয়ে যেতে পারেননি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
জাতীয় কবি কাজী নজরুলের কবিতায় বর্ষা যেন প্রেম আর বিরহের উৎসারক। কে ভুলতে পারে সেই অমর গান—
শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে/বাহিরে ঝড় বহে… নয়নে বারি ঝরে।
ভুলিও স্মৃতি মম নিশিথ স্বপন সম/ আঁচলের গাথা মালা ফেলিও পথ পরে
বাহিরে ঝড় বহে… নয়নে বারি ঝরে।/শাওন রাতে যদি…
আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন হলেও নতুন মেঘের ঘনিমার দিকে চেয়ে বৃষ্টির সুবাসে হৃদয়ে দোল লাগতে শুরু করেছে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। এবার যে জৈষ্ঠ্য মাসেই বৃষ্টি-বাদল শুরু। বৈশাখ আর জৈষ্ঠ্যের তীব্র গরমের প্রকৃতিতে আষাঢ় আসে হৃদয়ে শীতলতার পরশ বুলাতে। কিন্তু বৈষ্ণিক উষ্ণায়নের ফাঁদে পড়ে এবার যেন কিছুটা আগেই চলে এসেছে বৃষ্টি-বাদলার দিন। তাই আজ পহেলা আষাঢ় হলেও বর্ষাকালের মেঘ-বৃষ্টি ঘিরে বাঙালির যে রোমান্টিকতা, তাও যেন কিছুটা আগেভাগেই চলে এসেছে।
আষাঢ়ের কি আবার আলাদা জীবনযাত্রা হয়! আসলে আধুনিক এই ব্যস্ত সময়ে সেটি কিছুটা অবাস্তব শোনালেও আষাঢ় ঘিরে বদলে যায় বাঙালির জীবনযাত্রাও। এযে জলের দেশ, নদী, খাল আর বিলের দেশ। ভরা বর্ষায় মাঠঘাট চরাচর যখন ভেসে যেত বানের জলে, তখন বদলে যেত আবহমানকালের বাঙালি জীবনযাপনও। জল বাঁচিয়ে কোনরকমে রান্নাখাওয়া সেরেই সবাইকে আশ্রয় নিতে হত ঘরে। এসময়ে নারীরা ব্যস্ত হত নানারকম সৃজনশীল কাজে। নানারকম সুচিকর্ম, কারুকার্য ইত্যাদিতে সময় কাটাতেন তারা। অন্যদিকে এই বর্ষাতেই জমে উঠত নৌকা বাইচ উৎসব।
সেসব দিন গত হয়ে বাঙালি জীবনে প্রবেশ করেছে শহুরে জীবনযাপনের নানা বৈচিত্র। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থলে যেতে বর্ষার ঝাপটায় ভিজেনেয়ে একসা হওয়া যখন সেই জীবনের অংশ তেমনি পাকা রাস্তায় জল জমে মোটরগাড়ি আটকে যাওয়াও সেই জীবনের অংশ। এমনকি খোদ রাজধানীসহ বড় বড় শহরের প্রধান প্রধান শহরে জল জমে যাওয়ার চিত্র দেখা যাচ্ছে বর্ষা আসার আগেই। চট্টগ্রামের মত শহরে বহুতল ভবনের সামনে গাড়ির বদলে নৌকা বেঁধে রাখার চিত্রও দেখা গেছে তিনেক বর্ষা আগে।
রোগব্যাধিও
জলাবদ্ধতা, রোগশোক স্বত্বেও বাঙালি জীবনে এখনও আষাঢ় আসে রোমান্টিক বার্তা নিয়েই। তাইতো বৃষ্টির দেখা পেতে না পেতেই ঘরে ঘরে চুলায় বসে খিচুড়ির হাড়ি। বৃষ্টির দিন খিচুড়ি আর সামর্থ্য অনুযায়ী আচার, ভর্তা, ডিম বা মাছ-মাংসের নানা আয়োজন করে শহুরে বাঙালি। তাই বলা যায়, খিচুড়িও যেন এখন বৃষ্টিযাপনের অংশ। ঠিক তেমনি বর্ষার আরেক উপাদেয় খাবার গরম গরম চায়ের সঙ্গে ভাজাপোড়া। বৃষ্টি বিকেলে চায়ের আড্ডায় পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে যেন অন্যরকম উৎসবে মেতে উঠি আমরা।
বৃষ্টির সঙ্গে আলস্য আর গল্পগুজবের যেন সুপ্রাচীন সম্পর্ক। প্রাচীন বাংলায় যেমন মাঠ-ঘাট পেরিয়ে সুদূর গ্রাম থেকে ভেসে আসত বাঁশির সুর অথবা ভাটিয়ালি-কীর্তনের সুর, তেমনি ঘরে বসে গল্পগুজবেও কাটত সময়। কত আর জানা গল্প বলা যায়, কাহিনীর আগামাথা ছাড়িয়ে গল্পের গরু হয়ত গাছেই উঠে পড়ত। এভাবেই হয়ত আষাঢ়ে গল্পের নামকরণ। এখনও বৃষ্টির দিনে সন্ধ্যার পর ভুত-প্রেত আর রূপকথার গল্পে মেতে ওঠা বা পড়া বাঙালির প্রিয় অভ্যাস। যদিও প্রযুক্তির কল্যাণে এখন মুভি দেখা, গান শোনা, রেডিও শোনা ইত্যাদি নানা নতুন নতুন অভ্যাস যুক্ত হয়েছে আমাদের জীবনযাপনের তালিকায়।
বাঙালি জীবনযাপনের কথা বললে ফেসবুকের কথা না বললে তা অসম্পূর্ণই রয়ে যাবে। আমরা আমাদের দৈনন্দিন সুখদুঃখ, হাসিকান্না ভাগাভাগি করার মাধ্যম হিসেবে ফেসবুককেই বেছে নিয়েছি। এই ঘনবসতির দেশে বিশেষ করে শহরাঞ্চলে মানুষের জন্য বাইরে যেয়ে প্রকৃতিযাপন করা অনেকাংশেই সম্ভব না। তাই তো একফোঁটা বৃষ্টি নামতে না নামতেই ফেসবুকের টাইমলাইন জুড়ে দেখা যায় হাজারো স্টেটাস, লাইভ ভিডিও আর নানারকম অনুভূতির প্রকাশ। কেউ করেন স্মৃতি রোমন্থন, কদম ফুলের ছবি দেন কেউ কেউ। কেউ আবার জানালা দিয়ে দেখা এক চিলতে বৃষ্টিতে হাত ভেজানোর ছবি বা ভিডিও দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করেন, কেউ বা আবার বৃষ্টিদিনের খিচুড়ি বা চায়ের ছবি শেয়ার করেন। অনেকেই আবার বৃষ্টি নিয়ে প্রিয় গান বা কবিতাও শেয়ার দেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাতায়। এভাবে আরও অনেককিছুর মতই আমাদের আধুনিক শহুরে বাঙালির আষাঢ় যাপনও এখন অনেকটাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেন্দ্রিক।
বৃষ্টি ঘিরে বরাবরই রোমান্টির আমাদের কবি আর সঙ্গিত রচয়িতারা। এক রবীন্দ্রনাথেরই রয়েছে অসংখ্যা কালজয়ী কবিতা ও গান। এখনও বাঙালি বৃষ্টি নামলেই নিজের অজান্তেই গেয়ে ওঠে রবীন্দ্রসঙ্গিতের দুয়েক কলি বা কবিতার চরণ। লেখার শুরুতেই কবিগুরুর গানের চরণ দিয়েই শুরু। বাংলা ১৩০৭ সালেও যেন এখনকার মতই আষাঢ় কিছুটা আগেই এসেছিল। সেই সনের ২০ জ্যৈষ্ঠ শিলাইদহ বসে কবি লেখেন ‘আষাঢ়’ শিরোনামের কবিতা যার প্রথম দুই চরণ— নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে॥
বর্ষা নিয়ে কথা বললে সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাংলা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের কথা বলতেই হয়। অনেকেই বলেন, বাংলার তরুণ প্রজন্মকে নাকি বৃষ্টি ভালবাসতে শিখিয়েছেন তিনি। তার রচিত অসংখ্য উপন্যাস ও গল্পে তিনি বৃষ্টি ঘিরে অন্যরকম মাদকতা সৃষ্টি করেছেন। অনেকেই বলেন, তাদের নাকি বৃষ্টিতে ভিজিতে শিখিয়েছেন হুমায়ুন আহমেদ। তার রচয়িত ও শাওনের কণ্ঠে— যদি মন কাঁদে তবে চলে এস এক বরষায় গানটিও বর্তমান সময়ের তরুণ হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়।