
শোয়েব হোসেন : রাজধানীর উত্তরে এলাকার অলিতে গলিতে একের পর এক মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে বহুতল অট্টালিকা । এমনকি নির্মাণাধীন অবস্থায় অনেক ভবনের সামনে গেলে আবার দেখাও মেলে না “ভবণ নির্মাণাধীন সম্পকিত তথ্যাদি”। জানা গেছে,রাজধানীর উত্তরা ৬ নং সেক্টরে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উত্তরা জোনাল অফিস(গৃহায়ন ও গণপূর্ত মান্ত্রনালয়) অবস্থিত। বহুদিন যাবত বিভিন্ন মাধ্যমে ও প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে জানা গেছে উক্ত অফিস যেনো দুর্নীতির আখড়া !
উত্তরায় অবস্থিত রাজউকের জোনাল কার্যালয়ে আছেন পরিচালক(জোন ১ ও ২), নির্বাহী প্রকৌশলী(বাস্তবায়ন ৬ ও ৭), উপ-পরিচালক(এস্টেট ও ভুমি ২), উপ-নগর পরিকল্পনাবিদ(জোন ১ ও ২) ইত্যাদি । তবে অফিসে আমাদের প্রতিনিধি গেলে বিভিন্ন তথ্যের ব্যাপারে এদের কাউকেই সঠিক সময়ে পাওয়া যায় না। এমনকি উত্তরার এ রাজউক অফিসে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন জনের কাছে তথ্য জানতে চাইলেও রহস্যজনক কারণে অনেকেই কথা বলতে নারাজ! উত্তরা রাজউকের পরিদর্শক সরফুদ্দিনের সাথে পরিচিত হয়ে তার আওতাধীন এলাকার বিষয়ে চার চার বার জানতে চাইলেও তিনি অপকৌশলে এড়িয়ে গেছেন ! তখন বিভিন্ন ভবনের ডেভিয়েশন থেকে যাচ্ছে কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন , ” কোন ভবনটি সমস্যা ছাড়া আপনারাই বলুন ! আপনি নিজেও ভবন নির্মাণ করলে অবশ্যই ডেভিয়েশন করবেন! তবে গণমাধ্যমের সাথে কথা বলার মতো অনুমতি আমাদের দেননি চেয়ারম্যান স্যার। আপনারা অথরাইজড অফিসার এর সাথে আলাপ করে দেখতে পারেন”। গণমাধ্যম কর্মীগন আচানক সরফুদ্দিনের অসৌজন্য মুলক আচরণ সহ চাপিয়ে দেয়া অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে যান।অফিসে অথরাইজড অফিসারকে অনুপস্থিত পেয়ে সহকারী অথরাইজড অফিসার ” জান্নাতুল নাঈম” এর সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি জানান– “পরে কথা বলবেন, খুবই ব্যাস্ত”!
অফিস ঘুরে আরও দেখা যায়,নেমপ্লেট বিহীন জোন ২ এর পরিচালকের রুম তালা বন্ধ। সকাল সাড়ে ১০ টার দিকেও পাওয়া যায়না রাজউকের অনেক চাকুরেদের।উপস্থিত ব্যাক্তিদের জিজ্ঞাসা করে জানা যায়,”অফিসার -পরিদশর্করা মাঠের কাজে বাহিরে আছেন”। এ পর্যন্ত যতবারই রাজউক আফিসে তথ্যের জন্য যাওয়া হয় ততবারই একই অবস্থা দেখা যায়। এমনকি দেখা মেলেনি বর্তমান অফিসারদের নামের তালিকা,পদবী, দায়িত্বরত এলাকা বা ফোন নাম্বার! অনেক সেবা গ্রাহকেরা নানান কারণে হয়রানির শিকার হয়ে মন্তব্য করেছেন, “কেমন যেন অব্যাবস্থাপনা ও চারিদিকে চলছে যাচ্ছেতাই বেগতিক অনিয়ম “!
বহুদিন যাবত ঘুরে বহু চেষ্টায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানা যায়,দক্ষিনখানের আংশিক এলাকা উত্তরা রাজউকের আওতাধীন আর বাকিটা মহাখালী অফিসের আওতায়। আরও জানা যায়, উত্তরার সেক্টরের কোনো ভবনে খুব একটা সমস্যা বা ডেভিয়েশন নেই। তারপরও থাকলে বা অভিযোগ পেলে সত্তর ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হবে। জানতে চাওয়া হয় যে, নতুন আইন অনুযায়ী শোনা যাচ্ছিলো রাজধানীর উত্তরে রেল ক্রসিংয়ের ওপারে ৫ তলার বেশি উঁচু তলা ভবনের অনুমোদন পাবে না কোনো জমির মালিক।,এমন আইন মানা হচ্ছে কিনা ? রাজউক সুত্রে জানা যায়, ২০০৮ এর বিধিমালা অনুযায়ী যারা প্ল্যান পেয়েছেন শুধু তারাই ৫ তলার অধিক তলার ভবন নির্মান করতে পারবেন। আর ২০২২ সালের ২২শে আগস্ট এর পর থেকে নতুন আবেদন বা ছাড়পত্র নতুন নিয়মে চলছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, যদিও নতুন নিয়মে রাজউক(রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) রাজউকের প্লট বাদে অন্য কোনো ভবন ৫ তলার বেশি উঁচু তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেবেনা। তবুও বিভিন্ন ভবন মালিক কিছু অসাধু কন্ট্রাক্টর ও প্রকৌশলীর সহায়তায় রহস্যজনক ভাবে সাড়ে ৩/৪ কাঠা জমির ওপর ভবন নির্মানের জন্য ৭/৮/৯ তলা ভবন নির্মাণ করছেন! তাছাড়াও অনেক ভবনের সামনে ইট,বালু,সিমেন্ট ইত্যাদি ফেলে রেখে রাস্তায় চলাচলের বিঘ্ন ঘটানো হচ্ছে । শুধু তাই নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা মিলে না ভবন নির্মাণ সম্পর্কিত তথ্যাদির সাইনবোর্ড এমনকি সেফটি নেটেরও ! যে কোন মুহুর্তের দুর্ঘটনায় প্রকাশ্যেই ভয়াবহ ক্ষতি বা প্রাননাশের আশংকা ও হুমকির হাতছানি বিরাজমান!
আরও দেখা গেছে, ভবন নির্মাণ করতে হলে রাজউকের নকশার ওপর ভিত্তি করে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করতে হয়। কিন্ত, অধিকাংশ জমির মালিকরা ছাড় পত্র পেলেই নিয়মানুযায়ী রাজউককে লিখিত ভাবে অবহিত না করেই ভবন নির্মান কাজ শুরু করে দেন। রাজউকের নীতিতে লেখা আছে ভবন করতে হলে কোনো ব্যক্তি মালিকানাধীন বা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মোট জমির ওপর “ফার(ফ্লোর এরিয়া রেশিও)” অনুযায়ী জায়গা ছেড়ে ভবন নির্মান করতে হলেও তা সঠিক ভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছে না।
একাধিক সুত্রে খবর নিয়ে জানা গেছে , কোন ভবণ নির্মানে কমপক্ষে ৮ ফিটের রাস্তা থাকতে হবে। কিন্ত, সেখানে দেখা যায় রাজধানীর উত্তরে অনেক উঁচু ভবন গড়ে উঠেছে যেখানে ৬ ফিট রাস্তাও সঠিক ভাবে নেই। আর এ কারনে ভবিষ্যতে থেকে যায় প্রান নাশের মতো ভয়াবহতা ও ঝুঁকি। এমনকি এ ধরনের জমির মালিকরা মানছেনই না বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি)! শুধু তাই-ই নয়, ইমারত নির্মান সম্পর্কিত গেজেটে নিয়ম-নীতি থাকলেও তা জমির মালিকরা তোয়াক্কা করছেন না। এসব ভবন নির্মানের সময় অথবা নির্মাণের পরেও যেন কোনো পরিদর্শনও করেন না রাজউক কর্তৃপক্ষের কেউ! এমনও তথ্য আছে মাঝে মাঝে রাজউকের ইন্সপেক্টররা পরিদর্শনে গিয়ে ভবনের ত্রুটি ধরতে পারলেও তা আবার টাকার বিনিময়ে ধামাচাপা দিয়ে বিচারহীন থাকেন ।
এলাকার অনেকেই বলেন,আমরা দেখেছি কোনো এলাকায় যদি ভবনে আগুন লাগে বা দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে রাস্তার স্বল্পতার কারনে ফায়ার সার্ভিস ও এ্যাম্বুলেন্স সেই ভবনটির কাছে যেতে পারে না। যার কারনে ক্ষতির পরিমানও বেশি হয়। এমনকি যদি ভবিষ্যতে কখনো ভুমিকম্প হয় তাহলে এই বহুতল ভবন(৮/১০তলা) গুলোর অবস্থা কি হবে তা কি কেউ একবার চিন্তা করে দেখেছেন? তারা আরও বলেন, কয়েক মাস আগে সিরিয়া ও তুরস্কে যে ভুমিকম্প হয় তাতে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ গেছে। তবুও কি কারো শিক্ষা হয়না? সমাজের সচেতন ব্যক্তিরা বলেন,যাদের চক্রান্তে আজ দেশে এ ধরনের অবৈধ ও বহুতল ভবন নির্মান হচ্ছে সেই অসাধু ব্যাক্তিদের আইন মানতেই হবে।অন্যথায় তাদের জন্য প্রকাশ্য শাস্তিমুলক ব্যবস্থা জোরদার করা চাইই চাই।
জনমনে প্রশ্ন, ইতোমধ্যে বঙ্গবাজারে আগুনে পুড়ে সব ছাই হয়ে গেছে। সেই আগুনের লেলিহান শিখা পাশে থাকা এনেস্কো টাওয়ারে লেগে ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকা। এর থেকেও কি কারোর শিক্ষা হয় না! আবার এমন ঢাকা শহরে যে সব স্থানে ৭/৮ তলার বেশি অনুমোদন হয় না আর সে সব স্থানে কারা ৫ তলার পরিবর্তে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ১০/১২ তলা ঝুকিপূর্ণ ভবন এমনকি ৫ ফিটের রাস্তা আছে এমন স্থানেও বহুতল ভবন তৈরির গোপন রহস্য কি? ছাড়পত্র সেকশনের ব্যাক্তিরা অনিয়ম করে ও ফায়দা লুটে অনায়াসে ছাড় পেয়ে যাচ্ছে কিভাবে? তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে না কেন?
এলাকার সমাজ সচেতন ব্যক্তিরা বলেন,মানুষের জীবন নিয়ে এভাবে খেলা করার অধিকার কারোর নেই। তাই দুর্নীতিবাজ ভবন মালিক, প্রকৌশলী, কন্ট্রাক্টরদের প্রতি সংশ্লিষ্ট রাজউকের কর্মকর্তাদের দৃষ্টি রাখা উচিৎ । এখনই সময় এসেছে। আরও জানা গেছে, অনেক অসাধু জমির মালিকেরা গোপনে রাজউকের চাকুরেদের সহায়তা ও অনৈতিক সখ্যতার মাধ্যমে ভবন নির্মাণে অনিয়ম করছেন।কাজেই সহজেই বোধগম্য যে, অনিয়ম করে ভবন নির্মাণ ও ঘুষ বাণিজ্য যেন নিত্যকার চালচিত্র যা আজও থেমে নেই !
মন্তব্য এসেছে , ভবিষ্যতে এই সব ভবনে বসবাসরত মানুষের প্রানের ঝুঁকি থেকেই যায়। দুর্ঘটনা ঘটে গেলেও তখন আর খতিয়ে দেখার বা জবাবদিহিতা কারোর থাকে না। জনমনে প্রশ্ন থেকেই যায় এতো অনিয়মের সমাধান কোথায়?অনিয়ম প্রমানের পরেও বিচারহীন কিভাবে থাকছে ? কোন অপশক্তির বলে নতুন-পুরাতন অবৈধ ভবন নির্ভয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ?কোন ক্ষমতাধরদের অবৈধ কালো হাতের ঈশারায় আড়ালে চলছে অবৈধ ভবন নির্মাণ ? আর কতকাল এই অনিয়মের জয়জয়কার চলবে? আদৌ যদি অবৈধ ভবনের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেয়া হয়ে থাকে তাহলে অসংখ্য অবৈধ ভবনের ছড়াছড়ি কেন?এসব কথা আলাপ নাকি প্রলাপ?কেউ কি দেবে সদুত্তর বা উপযুক্ত জবাব? নাকি চলছে এবং চলতেই থাকবে অনিয়মের জয়জয়কার!