
লেখকঃ ওমায়ের আহমেদ শাওন।
ফয়েজ রোমানাকে স্বান্তনা দেবার জন্য এই প্রথম তার কাঁধে হাত রাখলো।
রোমানা কেঁদেই যাচ্ছে। সম্পর্কে রোমানা ফয়েজের মামাতো বোন। কিন্তু সম্পর্কের দিক ভিন্নখাতে প্রবাহিত হয় এমন আচরণেই। মামাতো বোনের সাথে বেশী মিশলে একে-অপরের প্রেমে পড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তারা প্রেমে পড়েছে কিনা সেটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না।
রোমানা কেঁদেই যাচ্ছে। মেয়েরা কাঁদলে কাঁদা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। নাহলে তারা রাগের বসে যেকোন কিছু করে বসতে পারে। ফয়েজ কান্না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করছে, কিন্তু কোনভাবে কান্না থামছে না।
কিছুক্ষণ পর রোমানা নিজের কক্ষে যায়। বালিশ জড়িয়ে হয়তো কাঁদবে-। ফয়েজ কোন প্রকার কথা বলেনা। রোমানার রুমে প্রবেশ করে সোফায় বসে পড়ে।
রোমানার বড় বোন রোকসানা কক্ষে প্রবেশ করে।
‘কি ব্যাপার ফয়েজ ভাই, রোমানা কাঁদছে কেন?’
-সেটা জানার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছি।
‘কিরে কাঁদছিস কেন রোমানা? কেউ কিছু বলেছে?’
রোমানা মুখ তুলে বলে, ‘কে কি বলবে?’
‘তাহলে কাঁদছিস কেন?’
রোমানা বলে, ‘এমনিতে। কাঁদতে ইচ্ছে করছে তাই।’
– আর কি কি ইচ্ছে করে শুনি? বলে ফয়েজ মৃদু হাসে।
ফয়েজের মুখে হাসি দেখে রোমানা ও রোকসানা দুজনে হাসে। মেয়েরা কাঁদতে কাঁদতে হাসতেও পারে, এটা রোামানাকে দেখলেই বোঝা যায়।
রোকসানা বলে, ‘ফয়েজ ভাই ! আপনার জন্য তালের পিঠা বানিয়েছি। খেয়ে যাবেন।’
রোমানা বলে, ‘আমিও পাঠিসাপটা পিঠা বানিয়েছি। খেয়ে যাবেন।’
ফয়েজকে কিছু খাওয়ানোর জন্য তারা রীতিমত প্রতিযোগীতা শুরু করে দেয়। বহুবারে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে ফয়েজ।
– আজকে কিছু খাবো না আর।
রোকসানা বলে, ‘খেয়ে যেতে হবে এটাই শেষ কথা।’
রোমানা বলে, ‘আমি কষ্ট করে বানিয়েছি। খেতে হবেই।’
অগত্যা ফয়েজ বলে- আচ্ছা।
সেদিন রাত্রে ফয়েজ অনেকবার চিন্তা করেছে- রোমানা কি জন্য কেঁদেছে তার কোন কারণ বের করতে পারেনি।
একদিন ফয়েজ নিমসার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে রোমানার জন্য অপেক্ষা করছে-।
রোমানা স্কুলের গেইট থেকে বের হয়েই ফয়েজকে দেখতে পায়।
‘ কি ব্যাপার ভাইয়া? মেয়েদের স্কুলের গেইটে কি?’
– তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
‘হুম। বুঝতে পারছি। আমাকে রিসিভ করার আড়ালে অন্য মেয়েদের দেখা হচ্ছে তাইতো?’
– আরে না। মেয়েদের প্রতি আমার কোন ইন্টারেষ্ট নেই।
‘ বাহ। তাহলে তো আপনি মহাপুরুষ !’
– সেটা বলতে পারো।
‘কচুর পুরুষ।’
রোমানা ও ফয়েজ হাঁটতে থাকে।
– কচুর পুরুষ মানে?
‘আরেকদিন মনে হলে বলবো।’
– আর আরেকদিন যদি মনে নাহয়?
‘তাহলে বলবো না।’
– তাহলে আজকেই বলো। কিছু বিষয়ের জন্য অপেক্ষা করা উচিত নয়।
‘কেন এসেছেন সত্যি করে বলেন তো।’
– মামী নিয়ে যেতে বলেছে।
‘আমি কি বাচ্চা নাকি? আমাকে নিয়ে যেতে হবে?’
-হুম। বাচ্চাই তো !’
‘মানে?’
– মামীর বাচ্চা।
ফয়েজের কথা শুনে রোমানা মৃদু হাসে।
রাত্রিবেলা ফয়েজের মনে রোমানার মুখটা বারবার ভেসে ওঠে। কিন্তু ফয়েজ তো রোকসানাকে পছন্দ করে। রোমানার মুখটা বারবার মনে পড়ার কারণ খুঁজে পাচ্ছে না।
রাত্রি দশটা। রোকসানা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে টকটক করে ফয়েজের দিকে তাঁকিয়ে আছে। ফয়েজ সেটা বুঝতে পারলেও লজ্জায় রোকসানার দিকে তাঁকাতে পারছে না। মানুষ যখন কাউকে ভালোবাসতে শুরু করে তখন তার দিকে তাঁকাতেও লজ্জাবোধ করে।
কিছুক্ষণ পর দরজার দিকে তাঁকিয়ে দ্যাখে- সেখানে রোকসানা নেই।
ফয়েজ কারণে-অকারণে রোকসানাদের বাসায় আসে। রোকসানার মা বিষয়টা লক্ষ্য করেও কিছেু বলেনা। কারণ, ফয়েজের মতো ছেলে জামাই হলে ভালোই। মেয়েকে তো কারো না কারো সাথে বিয়ে তো দিতেই হবে। আত্মীয়ের মাঝে বিয়ে দিলে মেয়েকে আজীবন দেখে-শুনে রাখতে পারবে। মেয়েকে চোখে চোখে রাখার আলাদা এক আনন্দ আছে।
ফয়েজ জরুরী এক কাজে কুমিল্লা শহরে অবস্থান করে। দুয়েক মাস চলে যায়। রোকসানাদের বাসায় আর যাওয়া হয়না। যোগাযোগ না থাকলে ভালো সম্পর্কগুলোও দূরের হয়ে যায়। ফয়েজ বুঝতে পারছে, দূরে থাকলেও ভালোবাসা কমেনা। একদিন প্রচন্ডভাবে রোকসানার কথা মনে পড়ে। রোকসানাকে যেভাবে হোক তার ভালোবাসার কথা জানাতে হবে। আর দেরী করা যাবেনা। যদি সে অন্য কাউকে মন দিয়ে ফেলে তখন আর কোন তদবির করে লাভ হবেনা।
সন্ধা গড়াতেই ফয়েজ রোকসানাদের বাসার অভিমুখে রওনা দেয়। যেতে যেতে রাত গড়িয়ে পড়ে। রোকসানা ঘুমিয়ে পড়েছে। ফয়েজ ডাক দিতে চেয়েও কেন জানি দিতে পারলো না।
রোকসানার রুম থেকে বের হতেই রোমানা ফয়েজকে দেখে বলে, ‘ফয়েজ ভাই। কি খবর? এতোদিন পর কি মনে করে?’
– কুমিল্লায় ছিলাম জরুরী কাজে।
‘ভুলেই গেছেন দেখা যায়। যেদিন থাকবো না সেদিন বুঝবেন।’
– কেন? তুমি কই যাবে?
‘মানুষের জীবনের কথা বলা যায়। কখন কি ঘটে !’
– ও আচ্ছা। সেটা সবারই।
‘রোকসানা আপু ঘুমিয়েছে। কিছু বলতে চাইলে আমাকে বলতে পারেন।’
-তেমন কিছু না। দেখলাম যে, জেগে আছে কিনা?
‘ডিনার করেছেন?’
-জ্বী।
‘তাহলে আপনিও ঘুমিয়ে পড়েন। কাল কথা হবে।’
– ঘুম আসবে না।
‘কেন?’
– এমনিতে।
‘তাহলে চলেন… জোৎস্না দেখি !’
-এতো রাতে?
‘রাতেই তো জোৎস্না দেখতে হয় !’
– আজকে দেখা যাবেনা।
‘কেন? আজকে আমাবস্যা নাকি?’
– সেটা না। রোকসানা জেগে থাকলে তিনজনে একসাথে দেখতাম।
‘ও আচ্ছা। আমার সাথে দেখতে অসুবিধা, তাইতো?’
– অসুবিধা নয়। আসলে এখন ইচ্ছে করছে না তাই।
‘থাক। আর কিছু বলবো না। কোনদিনও না।’
– এতো রাগ কেন? সুন্দরী মেয়েরা রাগ করলে মানায় না।
রোমানা কোন কথা না বলে তার কক্ষে চলে যায়।
মাঝাইয়া বাজার সাদিম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠান। কিন্তু ফয়েজ স্কুলে যায়নি। রোকসানাকে মনের কথাগুলো প্রকাশ করার জন্য বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করেও সফল হচ্ছে না। রোকসানা সামনে এলেই ফয়েজের মনের কথাগুলো হারিয়ে যায়। ফয়েজ পুকুর পাড়ে বসে রোকসানাকে নিয়ে ভাবতে থাকে। ইতিমধ্যে রোমানা এসে বলে, ‘রোকসানা আপু খালার বাসায় বেড়াতে গেছে।’
– ফয়েজ পিছন ফিরে বলে- তুমি তো আছো !
‘বাহ। কি বৃদ্ধি !’
-মানে?
‘সেটা বলবো না।’
– কেন?
‘আরেকসময় বলবো।’
– তুমি সবসময় অর্ধেক কথা বলো কেন?
‘ইচ্ছে করে তাই।’
– রোকসানা কবে আসবে?
‘আসলে বলবো।’
– থাক। বলতে হবেনা।
‘আম্মু ডেকেছে। এবার চলেন-।’
ফয়েজ ও রোমানা বাসার দিকে রওনা দেয়।
মামী ডাইনীং টেবিলে বসে আছে। ফয়েজ ও রোমানাকে দেখে বলে, ‘খাওয়া শেষ করে দুজনে পড়তে বসো।’
– রোকসানাকে দেখছি না?
‘ওর খালার বাসায় বেড়াতে গেছে।’
– কবে আসবে?
রোমানা বলে,‘আসলে দেখতে পারবেন।’
ফয়েজ কোন কথা না বলে চুপ থাকে।
আজকে মামা বাসায় নেই। রোকসানা থাকলে মনের কথাগুলো বলার সুযোগ মিলতো। কিন্তু সে নেই বলে ফয়েজের মনটা খারাপ।
সেদিন মাঝ রাত্রে রোমানার প্রচন্ড মাথা ব্যথা শুরু হয়। ফয়েজ ও মামী রোমানাকে নিয়ে অনেক আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কোন রকম রাত্রি পার হলে রোমানাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
ডাক্তার রিপোর্ট দেয়- রোমানার ব্রেন ক্যান্সার। ফয়েজ বুঝতে পারে, অকারণে কেউ কাঁদে না। একদিন যে রোমানা কেঁদেছিলো; সেটা অকারণে ছিলো না।
রোমানা ঘুমাতে কম, খাবার খেতো কম। সবসময় চিন্তাগ্রস্ত থাকতো। অথচ কেউ তা খেয়াল করেনি। রিপোর্টে সব উল্লেখ আসার পর বুঝতে পারে।
রোমানা হাসপাতালের বেডে শুয়ে ফয়েজের দিকে তাঁকিয়ে আছে। রোমানার জ্বলজ্বল চোখ দুটো দেখে ফয়েজের কান্না পেয়ে গেলেও কাঁদতে পারে না।
পরদিন খুব স্বাভাবিক ভাবে রোমানা সৃষ্টিকর্তার নিয়মে পৃথিবী থেকে নিঃশ্বাস নেওয়া বন্ধ করে দেয়। মামা-মামী, রোকসানা সহ সকলে দিশেহারা প্রায়। হাসি-খুশি মেয়েটা হঠাৎ এভাবে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যাবে, কেউ ভাবতে পারেনি।
রোমানা মারা যাবার চার বছর কেটে যায়। এতোদিন ফয়েজ তাদের বাসায় আর আসেনি। একদিন ফয়েজের মামী জরুরী ডাক দিলে ফয়েজ রোমানাদের চলে আসে।
ফয়েজকে দেখে মামী কাঁদতে শুরু করে।
– কি হয়েছে মামী?
‘মেয়েটার কথা মনে পড়ছে খুব।’
ফয়েজ তার মামীকে কোন স্বান্তনা দিতে পারেনা। সেও মায়াভরা চোখে তাঁকিয়ে রয়। মামী ফয়েজের হাতে একটি ডাইরী তুলে দেয়। ফয়েজ পাতা উল্টায়ে পড়তে থাকে। ডাইরীর পরতে পরতে রোমানার আবেগ আর ভালোবাসার কথা কারুকার্য খচিত। ফয়েজের চোখ জলে ভিজে যায়। রোমানা বেঁচে থাকাতে একটি বারের জন্যও সে বলতে পারেনি। ফয়েজ ভাবে, সেকি রোমানাকে ভালোবোসতো? নাকি তার চলে যাওয়াই হৃদয়ে ভালোবাসা বাড়িয়েছে। কিছু মানুষ জীবন থেকে চলে গেলেই কেবল তার মূল্য বোঝা যায়। বাড়ীতে অনেক লোকজন এসেছে। আজকে রোমানার আত্মার মাগফিরাত কামনার জন্য দোয়া অনুষ্ঠান চলছে। ফয়েজের চোখ থেকে জল পরে ডাইরীতে। ডাইরীর পাতা ভিজে যায়।
এমন সময় ফয়েজের স্ত্রী রাবেয়া ফয়েজের কাঁধে হাত দিয়ে বলে, ‘এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে লোকজনদের খাবার পরিবেশন করো। রাবেয়াকে দেখে চোখের জল মুছে।
যার জীবনে প্রকৃত ভালোবাসার মানুষ হারিয়ে যায়, সে যত সুখের সংসারই যাপন করুক না কেন তার ভেতরে ভেতরে শুনতা থেকেই যায়। ফয়েজ ভাবে, তার জীবনে রোমানা নেই, আছে শুধু কিছুকাল বেঁচে থাকার সময়। জীবনটা পরীক্ষা মাত্র। রোমানাকে সে যে মন থেকে ভালোবেসেছে; সে নিজেও কখনো বুঝে উঠতে পারেনি। ভালোবাসা কখনো বোঝা যায় না। সুপ্ত থাকে না বলা ভাষার মধ্যেই।
।। সমাপ্ত ।।